Thursday, May 2, 2013

আড্ডার কথা আড্ডায়-এক।। রেজা ঘটক

একবাক্যে সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা দিতে পারতাম। আরো দিতে পারতাম কুয়াশামোড়া নাগরিক গোধূলীর ভাঁপা পিঠার নিমন্ত্রণ। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে কিংম্বা টিএসসির বদ্বীপ সড়কের কোনায় দাঁড়িয়ে ভাঁপা পিঠা খেতে খেতে আড্ডায় যারা আনন্দ পায় না, তাদের কি অন্য কোন উষ্ণতায় শুভেচ্ছা জানিয়ে লাভ হবে? এমনিতে মানুষকে গায়ে পড়ে ভালো বুদ্ধি দিতে গেলে অনেকে গোস্যা করে। ভাব দেখায় সব জান্তা সমশের। নেহাত নিম্নর্বুদ্ধির কাজকেও মনে করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এই দলের লোকদের এড়িয়ে চলা একটি ফরজ কাজ। এই দলের লোকদের জন্য আমি কখনো শুভেচ্ছা দেই না। শুভেচ্ছা নেইও না। এদের সাথে কুতর্কে সময় নষ্ট করাও আহম্মকি। আমি খুব সচেতনভাবে এই গোষ্ঠীকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। যা বলছিলাম, আইডিয়া নিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ব্যাপারটি। আসুন, এবার একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা যাক, আড্ডায় আড্ডায়।

এই ফাঁকে বলে রাখি, ইতোমধ্যে যারা মনে মনে আমাকেও আহম্মক ভাবতে শুরু করেছেন, তাদের জন্য আমার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। ভিন্ন মত ভিন্ন চিন্তা থাকবে। চিন্তার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলন ঘটুক এটা আমারও চাওয়া। অথবা আজাইরা প‌্যাচাল পারছি, এমন ভাবলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার কথা বলছি, আপনার কথা আপনি বলবেন।

যাদের বয়স এখন ১৫ থেকে ৪৫-এর মধ্যে, তাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মাঝখানের এই ৩০ বছর সময়ই আপনার জীবনের সবচেয়ে সোনালি সময়। এই সময়কালে আপনি যা করবেন, বিপ্লবী বীরের মতো করবেন, নায়কের মতো করবেন, যোদ্ধার মতো করবেন। পুরোপুরি নিজেকে উজার করে দিয়ে করবেন, ভালো লাগা দিয়ে করবেন, ভালোবাসা দিয়ে করবেন। নিজে আনন্দ নিবেন। অন্যকেও আনন্দ দিবেন। দেখবেন, জীবনটা খুব এনজয়ফুল। তখন বোরিং কোনো গবেষণার কাজকেও আপনার মনে হতে পারে মহা আনন্দের কাজ।

আমরা যদি ১৫ থেকে ৪৫ বছরের বয়সক্রমকে তিনভাগে ভাগ করি, আমাদের কার কি কাজ, কিভাবে করলে সুবিধা, কে কোনটা করবে ইত্যাদি, তাহলে কি আপনারা শ্রেণী সচেতন ওয়ালারা আমাকে বর্ণ-বৈষম্যের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন?
যদি আপনাদের জোড়ালো উচ্চারণ হ্যা-কে জয়যুক্ত করে, তাহলে তো মনে হয় আমার লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানো অনেক উত্তম কাজ। আর যদি তাই না হয়, তাহলে, ১৫ থেকে ২৫ যাদের বয়স, তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে আমার ডানদিকে বসো। তোমাদের একটা নাম দেই, তাহলে হিসাবে আরো সুবিধা হবে। তোমাদের নাম হতে পারে প্রজাপতি ভোঁ ভোঁ গ্রুপ। অথবা চঞ্চল হৈ চৈ গ্রুপ। কিংম্বা আমার দেওয়া নামটা পছন্দ না হলে, নিজেরাও একটা সুন্দর নাম দিয়ে নিতে পারো। তোমরা হয়তো নিজেদের রয়েল গ্রুপও ভাবতে পারো। কারণ, এই বিষয়টায় সবচেয়ে তোমরাই বেশি লাভবান হবে। এটা কিন্তু চুপিচুপি বললাম। বড়োরা বুড়োরা যেনো না শোনে।

যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছর, তারা মনে করো, তোমরা হলে তালপাতার সেপাই গ্রুপ। অথবা হতে পারে, মাছি মারা হরিপদ কেরানি গ্রুপ। কিংম্বা হবু ফাস্ট লেডি বা সদ্য ফাস্ট লেডি অথবা আরলি মেরিজ জনিত জটাকলে আটকা পড়ে ফাস্ট লেডি শাসিত বসিভূত শোষিত হুকুম তালিমে নিষ্ঠাবান কামনেওয়ালা গ্রুপ। অথবা কামিনী যামিনী গ্রুপ। জীবনে মৃত্যু ছাড়া যাদের আর জামিন নেই। বাকি জীবন এরা মুক্ত থেকেও প‌্যারোল পায় না। কিংম্বা এদের নাম হতে পারে, কামড়া-কামড়ি গ্রুপ। তোমরা এবার কামড়া কামড়ি ছেড়ে একদম চুপ চাপ হয়ে বসো। নইলে কারো কথা কেউ শুনতে পাবে না। আর তোমাদের যুদ্ধটা বাসায় গিয়ে দরজা আটকে কইরো। আমরা চোখ বন্ধ রাখবো। অতো দূরে কেনো? তোমরা ঠিক আমার এই বাম পাশটায় হাতের নাগালের মধ্যে বসো। যাতে মারামারি-টা কন্ট্রোল করা যায়। কি বল্লে? তোমরা বেশি বেশি কামড়া কামড়ি করবে? কইরো, এখন একটু চুপ থাকো। দেখো না ওই যে মুরব্বিরা দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু মনে করবেন না, ভাইয়েরা। ওরা এই রকম। ঘরে বাইরে সারাক্ষণ কামড়া কামড়ি করে। আপনাদের যাদের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ তারা আমার ঠিক সামনা সামনি বসেন। আপনারা তো মুরব্বি। আপনাদের আজ যে জন্য ডেকেছি, তা একটু পরেই বুঝতে পারবেন। দয়া করে আপনাদের পরিচয়টা একটু যদি এক এক করে সবাই বলেন, আপনাদের পরিচয় পেলে আমরা বড়োই কৃতার্থ হই।

এই যে ভায়া, হ্যা, আপনি শুরু করেন। নেড়ে মাথা থেকে ক্যাপ নামিয়ে উনি পাল্টা আমার কাছে জানতে চাইলেন- আমাকে বলছেন?
- জি, আপনাকে। আপনি দেখতে অনেকটা আমাদের প্রিয় আহসান ভাইয়ের মতো। আপনি কি আমাদের আহসান কবিরকে চেনেন? আপনিও কি এখনো ব্যাচেলর মাল?
- ত..ত.তোমার মাথা। আ.. আমাকে নিয়ে কি আপনি ম-ম-ম মসকরা করছেন?
- না, মসকরা কেন করবো? আপনি তো আমাদের সম্মানিত গেস্ট। আপনার কাছে আমরা আপনার পরিচয় জানতে চাইছি। এই সভায় নয়া কেউ আসলে এটাই রেওয়াজ, বুঝলেন?
_ আত..ছা। ব-ব-ব বলছি। তার আগে একটু পাস করা যাবে? মা মানে, মাইসাস, ভিষণ চাপ। ফ-ফ-ফ ফেটে যাবার মতো অবস্থা।
আপনারা যারা দেরিতে আসছেন, বুঝতেই পারছেন, মুরব্বি-র একটু হালকা হওয়া এই মুহুর্তে কতোটা জরুরি। আমরা কি মুরব্বির জন্য অপেক্ষা করেবো?

আমাদের এই ছোট্ট হলরুমটা প্রথম প্রথম কিন্তু এমন কানায় কানায় ভরতো না। দেওয়ালের ওই যে ছবিটা দেখছেন, উনিই আমাদের এই আড্ডার গুরু। আমাদের প্রিয় সঞ্জীব দা, সঞ্জীব চৌধুরী। আড্ডাবাজ প্রাণখোলা মানুষটা আমাদের জন্য এখন শুধুই স্বৃতি। কিংবদন্তি একদিন বড়ো হবে। ধীরে ধীরে আমাদের এই আড্ডার কথা কিংবদন্তিও একদিন জানবে। কথায় কথায় সঞ্জীব দা আইডিয়া দিতেন। বলতেন, এ্যান আইডিয়া ক্যান চ্যাইঞ্চ ইয়োর লাইফ। শুধু আড্ডা মারবে না। আড্ডায় আইডিয়ার কথা বলবে। আইডিয়া একদিন সমাজ বদলে দেবে। আমরা সঞ্জীব দা'র কথা মাথায় রেখে এই আড্ডার নাম দিয়েছি- `আড্ডায় আড্ডায় আইডিয়া'। তার আগে আমরা এখন ফ্লোর দেবো আমাদের প্রিয় আহসান ভাইকে। আহসান কবির। সঞ্জীব দা'র খাঁটি শিষ্য।

কেমন আছেন সবাই? সঞ্জীব দা'র কথা যখন হচ্ছিল, তো সঞ্জীব দা'র একটা মজার হিস্ট্রি দিয়ে শুরু করি। সঞ্জীব দা গেছেন ছফা ভাইয়ের বাসায়। ছফা ভাই মানে আহমাদ ছফা। গিয়ে দ্যাখেন, ছফা ভাই সারা ঘরে পায়চারি করছেন। কিছুটা চিন্তিত। সঞ্জীব দা জানতে চাইলেন, ছফা ভাই, আপনি কি কোন সমস্যায় পড়েছেন?
ছফা ভাই হাঁটছেন আর কথা বলছেন। সঞ্জীব, তুমি কি আমাকে একটু হেল্প করবে? আমাকে একজন ফটোগ্রাফার দিতে পারো?
সঞ্জীব দা, জানতে চাইলেন, ফটোগ্রাফার দিয়ে কি করবেন, ছফা ভাই?
- ছবি তোলাবো। ছফা ভাইয়ের জবাব।
সঞ্জীব দা জানতে চাইলেন, কার ছবি?
- কার আবার আমার। আমার ছবি তোলাবো।
- কখন তুলেত চান? হঠাৎ ছবি তুলবেন কেন? কি হয়েছে? ছবি কাকে দেবেন?
ছফা ভাই?
- একটু আগে তসলিমা এসেছিল। ওকে আমার একটা ছবি দিতে হবে।
- কখন দিতে হবে?
- কাল সকালে।
- বাইরে টাইরে যাচ্ছেন নাকি?
- না।
- তাহলে ছবি দিয়ে কি করবেন? আর এতো তাড়াহুড়ো বা কিসের?
- তুমি বুঝতে পারছো না, সঞ্জীব।
- না বোঝার কি আছে? তসলিমাকে আপনার একটা ছবি দিতে হবে কাল সকালে। কাউকে বলে দেব। ছবি তুলে দেবে। এজন্য আপনি এতো চিন্তা করছেন কেনো, ছফা ভাই? আপনি বসেন তো, ছবি তোলা যাবে। আমি আপনার সাথে একটা সিরিয়াস বিষয়ে পরামর্শ করতে এসেছি। আপনি একটু বসেন, ছফা ভাই।
- আগে তুমি আমার ছবি তোলার ব্যবস্থা করো। তারপর তোমার কথা শুনবো।
- ছফা ভাই, বিষয়টা সিরিয়াস।
- আমার বিষয়টাও সিরিয়াস। তুমি বুঝতে পারছো না, সঞ্জীব।
- বলেন, আপনার সিরিয়াস বিষয়টাই আগে শুনি।
- তসলিমা নাকি এখন ঢাকা মেডিকেলে বসে! একটু আগে ও এসেছিল। আমার অবস্থা দেখে তসলিমা বললো, আপনি সকালে চলে আসেন। আমি চেক-আপ করে দিচ্ছি।
- তো যাবেন। চেক করাবেন। অসুবিধা কোথায়?
- সেজন্যই তো বললাম, তুমিও বুঝলে না আমার কথা।
- না বোঝার কি আছে?
- না আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাবো না।
- এটা কিন্তু ঠিক না, ছফা ভাই। আপনি অসুস্থ। মেডিকেলে যাবেন। চেক-আপ করাবেন। এটা না মানার কি আছে?
- অসুস্থ কিসের তা না শুনেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে? গাধা কোথাকার।
- আমি কিন্তু আপনার কথা এবার কিছুই বুঝলাম না।
- তুমি ফটোগ্রাফার দিতে পারবে কিনা বলো? নইলে বিদায় হও।আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
- ছফা ভাই, সত্যি করে বলেন তো, অসুস্থতার সাথে ছবি তোলার ব্যাপারটা কিসের?
- আমার পাছায় একটা ফোঁড়া উঠেছে। সেজন্য আমি কয়েক দিন বসতে পারছি না। তসলিমাকে বললাম, কোনো অসুধ খেলে সারবে কিনা? ও বলল, সকালে আসেন, চেক করে দেখি।
-তারপর?
- তুমি বলো সঞ্জীব, তসলিমাকে আমি কি পাছা দেখাতে পারি? তুমি একজন ফটোগ্রাফার ডাকো, ও ছবি তুলুক। তসলিমাকে পাছা দেখানোর চেয়ে ছবি পাঠাব ভেবেছি। তুমি ফটোগ্রাফার না নিয়ে আসবে না বলে দিচ্ছি।
তারপর সঞ্জীব দা ফটোগ্রাফার খুঁজতে বের হয়ে গেলেন।